তখন সবে দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী তিনি। আর দশটি শিশুর মতোই হেসে-খেলে বেড়ে উঠছিলেন। তবে হঠাৎই নেমে আসে মস্ত বড় একটা বিপদ। সময়টা ২০০২ সাল। পাশের বাড়ির ছাদে বন্ধুদের সঙ্গে খেলার সময় বিদ্যুতস্পৃষ্ট হয়ে তার হাতের কনুই পর্যন্ত পুড়ে যায়। আর্তচিৎকার শুনে প্রতিবেশীরা উদ্ধার করে তাকে নিয়ে যায় হাসপাতালে।
দেশের চিকিৎসায় ভালো না হওয়ায় একসময় কলকাতায় নেয়া হয় তাকে। প্রথমে তো কোনো বেসরকারি হাসপাতালও ভর্তি নিতে চায়নি। পরে অনেক কষ্টে কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। বলছি ফাল্গুনী সাহার কথা। অনেক চড়াই উতরায় পেরিয়ে আজ তিনি সফল।
পড়াশুনা করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগে স্নাতকোত্তর পর্বে। গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর গলাচিপায়। তার হাত দুটি নেই বললেই চলে। কিন্তু তাতে দমে যাননি ফাল্গুনী। এখন তিনি একটি বেসরকারি কোম্পানির হিউম্যান রিসোর্স অফিসার। কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে সে যখন ভর্তি হয় তত দিনে তার হাতে পচন ধরে গেছে।
সেখানকার ডাক্তার বলেন, বড্ড দেরি হয়ে গেছে। এভাবে পচতে থাকলে একসময় ক্যান্সার হয়ে যেতে পারে। তাই হাত আর রাখা যাবে না। যাই হোক, কনুই থেকে কেটে ফেলা হলো ফাল্গুনীর দুই হাত। হাতের ঘা শুকাতে মাস চারেকের মতো লাগল। প্রতিবেশীরা আফসোস করে বলত, মেয়েটার আর পড়াশোনা হবে না। তবে ফাল্গুনী দমে যাওয়ার পাত্রী নন।
কাগজ-কলম দেখলে মন খারাপ হতো। সহপাঠীদের স্কুলে যেতে দেখলে চোখের কোণে জল আসত। ভাবতেন, ‘পৃথিবীতে কিছুই তো অসম্ভব নয়। তবে আমি কেন পারব না?’ একদিন সাহস করে কলম নিয়ে খাতার ওপর লিখতে চেষ্টা করলেন। এভাবে কিছুদিন প্র্যাকটিস করলেন। পরে একদিন দুই হাতের কনুইয়ের মাঝখানে কলম রেখে লেখার কৌশল আয়ত্তের চেষ্টা করলেন।
এ বিষয়ে ফাল্গুনী বলেন, শুরুতে ভীষণ কষ্ট হতো। এলোমেলো হয়ে যেত লাইন। কলম ধরতে ধরতে একসময় হাতে ইনফেকশনও হয়েছিল। ডাক্তারও বারণ করেছিলেন এভাবে লিখতে। তবে আমি হার মানিনি। অদম্য ইচ্ছাশক্তির জোরে একসময় ঠিকই লেখা আয়ত্তে চলে আসে। পরের বছর তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। গলাচিপা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পেলেন।
গলাচিপা মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলেন। ফাল্গুনীর কথা জানাজানি হলে ঢাকার ট্রাস্ট কলেজের অধ্যক্ষ বশির আহমেদ তাকে ঢাকায় এনে ট্রাস্ট কলেজে ভর্তি করিয়ে দেন। কলেজের হোস্টেলেই থাকতেন। এখান থেকে এইচএসসিতে মানবিকে জিপিএ ৫ পেয়ে ফাল্গুনী প্রমাণ করলেন, মানুষ চাইলে সবই পারে! পরীক্ষাকেন্দ্রে তার জন্য আলাদা বসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। দুই কনুইয়ের মধ্যে কলম চেপে ধরে লিখতেন তিনি।
এইচএসসি ফলাফলের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার কোচিংয়ের সময় ফার্মগেটে ছিলেন কিছুদিন। পরে সূত্রাপুর ও লালবাগে দুই আত্মীয়ের বাসায় থেকেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে পড়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু সে সুযোগ হয়নি। ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগে। অনার্সে সিজিপিএ ৩.৫০ পেয়েছেন। এখন সেখানে মাস্টার্সে পড়ছেন।
চার বোনের মধ্যে ফাল্গুনী তৃতীয়। তার বাবা জগদীশচন্দ্র সাহা, মা ভারতী সাহা। ছোটখাটো একটি মুদি দোকান ছিলো তার বাবার। তবে তাদের আবার দুর্ভাগ্য নেমে আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার কয়েক দিন পর বাবাকে হারান ফাল্গুনী। তখন তিনি সবে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু করেছেন আর তার ছোট বোন নবম শ্রেণির ছাত্রী। দুই মেয়েকে নিয়ে ভারতী সাহা যেন অথৈ জলে পড়লেন। মিষ্টির বাক্স বিক্রি করে কোনো মতে সংসার চালাতেন। ছুটিতে বাড়ি গেলে এ কাজে মাকে সাহায্য করতেন ফাল্গুনী।
প্রথম বর্ষে পড়ার সময় সাভারে একটি টিউশনিও পেয়েছিলেন মাসে দেড় হাজার টাকায়। কিন্তু মাস দুয়েকের বেশি চালিয়ে নিতে পারেননি। কারণ অভিভাবকদের ধারণা, আমার হাত দুটি নেই। লিখতেও কষ্ট হয়। তাই আমি পড়াতে পারব না! টিউশনি চলে যাওয়ার পর চরম অর্থকষ্টে কাটে কিছুদিন। পরে এলাকার এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে যোগাযোগ হয় ‘মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’-এর প্রতিষ্ঠাতা আমেরিকা প্রবাসী চন্দ্র নাথের সঙ্গে। সেখান থেকে বৃত্তির ব্যবস্থা হলো।
এ বিষয়ে ফাল্গুনী বলেন, মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন থেকে প্রতি মাসে যা পেতাম তা দিয়ে খরচ মিটে যেত। সত্যি বলতে কী, ওই সময় বৃত্তি না পেলে হয়তো পড়াশোনায়ও ইস্তফা দিতে হতো। পরিবার, শিক্ষক, বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে সব সময় সহযোগিতা পেয়েছি। সবার কাছে কৃতজ্ঞ আমি। তিনি আরো বলেন, পড়াশোনার সময় তো বৃত্তির টাকাতেই চলেছি। কিন্তু মাস্টার্স শেষে কী হবে এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলাম। এর মধ্যেই গত ১৭ অক্টোবর একটি সুখবর পাই। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকে হিউম্যান রিসোর্স অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় আমাকে। আগামী মাসের ৩ তারিখে যোগদান করার কথা।
পাহাড়সম বাধা পেরিয়ে এই পর্যায়ে এসে ফাল্গুনী সাহা বলেন, জীবনে অনেক কষ্ট করে এই অবস্থানে এসেছি। ইচ্ছাশক্তির জোরে এতো দূর আসা। আমার মা অনেক অসুস্থ। বসে বসে কাজ করতে গিয়ে তার হাড় ক্ষয়ে গেছে। কিছুদিন আগে ব্রেইন স্ট্রোকও করেছেন। মাকে ভালো ডাক্তার দেখাব। ছোট বোন এখন অনার্সে পড়ছে। তাকেও সহযোগিতা করতে চাই।
সিআরএম ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে অভিনন্দন !
#bangladesh #women #নারীশক্তি #সাফল্য #নারীদের #সিআরএম
COASTAL RESOURCE MANAGEMENT CRM- Foundation 218, Brown coumpund Road, Barishal. www.crmbd.net Information officer Md. Naymun Islam 01740-665545
Mobie +8801740-665545
Telephone +8802478830691
hrcrmbd@gmail.com
infocrmbd@gmail.com
© This website is owned by CRM Foundation. Copying any of its content is illegal www.crmbd.net
Website Design and Developed by ENGINEERS BD NETWORK